আমি এতগুলো বছর ধরে তো অগণিতও বিনিয়োগকারীর সাথে কথা বলেছি, ১০০ জনের মধ্যে ৯৫ জনের কাছ থেকে যে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হই সেগুলো এইরকম :
"এখন স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করব ?"," কোন শেয়ার নেওয়া যায় এখন ?"," কেমন যাবে স্টক মার্কেট সামনে ?" প্রশ্নগুলো শুনলেই কেমন নিজেকে জ্যোতিষী জ্যোতিষী লাগে। এইসব মানুষগুলো খুব একটা দূরের কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য রেখে কথাগুলো যে বলছে না সেটা ভালই বুঝতে পারি । রাতারাতি বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোকে শেয়ার বাজার সম্বন্ধে ভুল ভাঙাতেই আমার অনেকদিন লেগে যায়। শেয়ার বাজার ছেড়ে যদি অন্য কোনও বিনিয়োগের কথা হয় সেখানেও প্রায় একই রকমের প্রশ্ন -"ভালো মিউচুয়াল ফান্ড স্কিম কোনটা?","এখন কোন মিউচুয়াল ফান্ড স্কিম কেনা যায়?", "সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ কি হবে এইবছর?"," রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করা উচিত হবে কি আমার ?" এই সবের বাইরে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই সেটা হল "আমার বিনিয়োগ কি সঠিক আছে? নাকি আমার কিছু পরিবর্তন করার দরকার আছে ?" মানে নিজে নিজে কিছু একটা বেশকয়েক বছর ধরে করার পর ঘেঁটে রেখে যখন দেখে রিটার্ন ঠিকঠাক হচ্ছে না, তখন ফাইনান্সিয়াল প্রফেশনালকে মনে পড়ে।
প্রকৃতপক্ষে উপরের সব প্রশ্নগুলোই ভুল, বিনিয়োগকারী কিসে বিনিয়োগ করবে সেটা মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে যায়, বিনিয়োগকারী চাহিদা কি সেটা নিয়ে আলোচনা হয় না । আরো অসুবিধা হয় যখন, অনেক সময় বিনিয়োগকারীই কুণ্ঠাবোধ করে নিজের সব রকমের চাহিদা, ইচ্ছা, স্বপ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করতে। উপরের প্রশ্নগুলো অনেক পরে আসবে, প্রথম যে প্রশ্নটা আসবে সেটা হল "কেন ?"। বিনিয়োগের আলোচনা অবশ্যই "কেন" দিয়ে শুরু করতে হবে - অর্থাৎ বিনিয়োগের উদ্দেশ্য কি ? "কেন একজন বিনিয়োগ করছে?" এই প্রশ্নের উত্তর সাধারনত যেগুলো পাই-
"অবসরে জীবনযাত্রার জন্য অর্থের প্রয়োজন", " ছেলে বা মেয়ের আগামী দিনের শিক্ষার জন্য বা আরো উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থের প্রয়োজন", "ছেলে বা মেয়ের বিয়ের খরচ", "বাড়ি কেনা বা সংস্কার করা", "দেশ বিদেশ ভ্রমণ","একটি গাড়ী কেনা", "নিজের ব্যবসা শুরু করা বা তাড়াতাড়ি কর্মজীবন থেকে ছুটি নেওয়া" ইত্যাদি। বিনিয়োগকারীর এই উত্তরগুলো সবই আর্থিক উদ্দেশ্য, যখন একজন আর্থিক উপদেষ্টা এই উদ্দেশ্যগুলির জন্য কতদিন সময় আর বাকী আছে ,কতটা টাকার দরকার এবং সেই সময়ের মধ্যে কত টাকা মাসিক বা বাৎসরিক বিনিয়োগ করতে হবে, এই সবকিছু নির্ধারণ করলে সেটাকে আর্থিক লক্ষ্যে রূপান্তর করা হয়েছে বলে, বলা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় চিত্রটা অন্যরকম, লক্ষ্যে অর্জনের জন্য ব্যয় বেশি হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ বিনিয়োগকারী আয় (বেতন, পেশাদার ফি, ইত্যাদি থেকে) লক্ষ্যে অর্জনের জন্য যতটা প্রয়োজন তার তুলনায় পরিমাণে কম হয়ে যাচ্ছে। এখানেই বিচক্ষণ আর্থিক উপদেষ্টার কাজ , কত ভালো ভাবে সে বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও বানাচ্ছেন। কিন্তু আমি এটাও দেখেছি অনেক বিনিয়োগকারী এইভাবে ইনভেস্টমেন্ট পছন্দ করেন না , তাদের মনে হয় যখন যেমন সময় আসবে তখন তেমন করব। এটা সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি , বিনিয়োগের পরিকল্পনা করার সময় লক্ষ্য নির্ধারণ অনুযায়ী চলা একটি অত্যন্ত ভালো অনুশীলন।
লক্ষ্য নির্ধারণের প্রথম ধাপ হল জীবনের এই ঘটনাগুলো চিহ্নিত করা। কিন্তু জীবন তো সরল রেখাতে চলে না। আকাঙ্খিত বিষয়গুলি পরিকল্পনা করা যেতে পারে, কিন্তু অবাঞ্ছিত কিছু ঘটনাও তো হতে পারে, চমক হিসাবে ঘটতে পারে সেগুলো? সম্ভাব্য নেতিবাচক ফলাফলের সাথে অবাঞ্ছিত সেই ঘটনাগুলি যেমন হাসপাতালে ভর্তি, পরিবারের একজন সদস্যের মৃত্যু, দুর্ঘটনা, চুরি, আগুন, ভূমিকম্প বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাড়ি বা মূল্যবান সম্পত্তিগত ক্ষতি ইত্যাদি। কেউ বিনিয়োগের মাধ্যমে এই ধরনের ঘটনাগুলির সাথে যুক্ত খরচের জন্য তহবিল বানানোর পরিকল্পনা করতে পারে না, কিন্তু আর্থিক উপদেষ্টার প্রথম কাজই হবে যথেষ্ট পরিমাণের জরুরি তহবিল (Emergency Fund) তৈরি করা । এর সাথে সাথেই জরুরী তহবিল ছাড়াও, বিনিয়োগকারীর জন্য এই ধরনের ঘটনাগুলির ঝুঁকি কভার করার জন্য বীমা পলিসি কেনবার পরামর্শ দেওয়া। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো বীমা পলিসি বিনিয়োগ বা ইনভেস্টমেন্ট নয়, যেটা অধিকাংশও ভারতীয় ভুলটি করে থাকেন। এই বিষয়ে পরে একদিন বিশদে আলোচনা করব।
ফিরে আসি আমরা মূল আলোচনাতে, তাহলে লক্ষ্য নির্ধারণের প্রথম ধাপ ছিল জীবনের আকাঙ্খিত ঘটনাগুলো সনাক্ত করা, এবার দ্বিতীয় ধাপ অগ্রাধিকার বরাদ্দ করা অর্থাৎ জীবনের আকাঙ্খিত ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনটি অন্যগুলির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন অবসর গ্রহণ অথবা ছেলে বা মেয়ের শিক্ষা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, যেখানে একটি দুর্দান্ত ছুটি একটি ভাল লক্ষ্য হতে পারে। আর্থিক উপদেষ্টাকে এর পর অপেক্ষা করতে হবে বিনিয়োগকারী ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সিদ্ধান্তর জন্য। একজন আর্থিক উপদেষ্টা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে গাইড এবং সাহায্য করতে পারেন কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টা অগ্রাধিকার পাবে সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিতে হবে বিনিয়োগকারীকেই।
এর পরে তৃতীয় ধাপ, বিনিয়োগকারীকেই টাইমলাইন বরাদ্দ করতে হবে, সেইসাথে এই ধরনের ইভেন্টের সময় প্রয়োজনীয় তহবিলের পরিমাণ। উদাহরণ স্বরূপ ধরুন, কেউ যদি বাড়ি কেনার পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে তাকে ঠিক করতে হবে যে কোন ধরনের বাড়ি চায়, সেইসাথে কোন জায়গায় (Location)। এই ইনপুটগুলি আনুমানিক খরচে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। এর পরে, কখন এটি কিনতে চান তা নির্ধারণ করতে হবে। লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা সঠিক হওয়ার জন্য সময়রেখা (Timeline) এবং কত টাকার দরকার উভয়ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইনপুট। স্বল্পমেয়াদী প্রয়োজন বনাম দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য, একজন আর্থিক উপদেষ্টার কাজ আগে সেটা ঠিক করে নেওয়া, তারপর টাইমলাইনের পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্যগুলিকে কিভাবে লক্ষ্যভেদ করা যায় সেটাই তার নিজস্ব মুন্সিয়ানা।
আমরা যদি সম্পূর্ণ বিষয়টা উদাহরণের মাধ্যমে বুঝি তাহলে আরো সুবিধা হয় : রজত দত্ত একজন চাকুরিজীবি, বয়স 39 বছর, তাঁর স্ত্রী অনামিকা দত্ত এবং তাঁদের আট বছরের কন্যা সন্তান রিয়া কলকাতায় একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। রিয়ার উচ্চশিক্ষা প্রায় দশ বছর দূরে, রজতবাবু আরও একুশ বছর কাজ করতে পারবেন। দত্ত পরিবারের আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটি বাড়ি কেনার প্রয়োজন আছে। অবসরের জন্যও রজতবাবুকে টাকা জমাতে হবে কারণ ওনার কোনও পেনশনের বন্দোবস্ত নেই। অবসর গ্রহণের লক্ষ্যকে আবার দুটি ভাগে বিভক্ত করতে হবে - অবসর গ্রহণের জন্য একটি সমষ্টি জমা করা এবং তারপর সঞ্চিত কর্পাস থেকে আয় নেওয়া।
আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আসবে যেমন: রিয়ার শিক্ষা খাতে কত খরচ হবে? রিয়ার কলেজে পৌঁছানোর পর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আর সেটা এখন থেকে প্রায় এক দশক (10 বছর) পরে, সেক্ষেত্রে খরচ অনেকটাই বাড়তে পারে। আগামী দিনের লক্ষ্যকে স্থির করতে গেলে মুদ্রাস্ফীতি নামক সূচককে নিয়ে চলতেই হবে। মুদ্রাস্ফীতি ব্যক্তিগত অর্থায়নের অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যা ছাড়া সমগ্র পরিকল্পনাটি বিপর্যস্ত হতে পারে। শিক্ষার ব্যয় গত কয়েক দশক ধরে খুব দ্রুত গতিতে বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, যা অবসরের বছরগুলিতে ব্যয়ের উপর একটি বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
বর্তমান বা আজকের দিনের টাকার হিসাবে রিয়ার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে খরচ 30 লক্ষ, কিন্তু রিয়া কলেজে যাবে 10 বছর পরে। যদি কলেজের ফি-তে মুদ্রাস্ফীতি 6% p.a. হারে বৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হয়, রিয়ার বাবা-মাকে 10 বছরে 53,72,543 টাকা আনুমানিক খরচ ধরে চলতে হবে। এখানে অনেকগুলি অনুমান জড়িত, সঠিকভাবে পরিকল্পনা করার জন্য কিছু অনুমান দিয়ে শুরু করতে হবেই। অন্যথায়, অভিভাবকরা টাকা জমা করার পরিকল্পনা করতে পারেন না ৷
মুদ্রাস্ফীতির একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে, এবং তাই দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলির অর্থায়নের পরিকল্পনা করার সময়, মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করতে হবে। অন্যদিকে, দামের পরিবর্তনের কারণে তাৎক্ষণিক বা নিকট-মেয়াদী লক্ষ্যগুলির উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে না। যদি মুদ্রাস্ফীতি 6 শতাংশ p.a. হয়, তাহলে আজকের জীবনযাত্রার খরচের তুলনায় রাজতবাবুর পারিবারিক খরচ এক বছর পরে বেশি হবে। যদি একটি পরিবারের মাসিক খরচ হয় বর্তমানে 30,000 টাকা, আগামী বছর মূল্যস্ফীতি 6% হলে আগামী বছর 31800/- টাকা। এটি খুব বেশি মনে হচ্ছে না, তাই না, তবে মূল্যস্ফীতি একই স্তরে থাকলে, এই পরিবারের মাসিক খরচ 10 বছর পর 53,725 টাকা ; এবং 20 বছর পর 96,214 টাকা হয়ে যাবে।
এই সমস্ত আর্থিক লক্ষ্যগুলির রূপায়নের সময় সবচেয়ে বড় সমস্যা হল নগদ টাকার যোগানের অমিল। হয় ব্যয় সেই সময়ে আয়ের চেয়ে অনেক বেশি, অথবা প্রত্যেকটি লক্ষ্য ধরে ধরে মাসিক বা বাৎসরিক পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করার পরে দেখা যায় বিনিয়োগকারীর আয় তার বিনিয়োগের তুলনায় কম হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু এগুলি ভবিষ্যৎ লক্ষ্য, একজন ব্যক্তি সঞ্চয় জমা করার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে পেয়ে যান, তাই একজন আদর্শ আর্থিক উপদেষ্টার কাজ হবে উপযুক্ত বিনিয়োগের মাধ্যম খুঁজে বের করা যাতে মুদ্রাস্ফীতিকে হারিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে সঞ্চিত টাকাটা বৃদ্ধি পায়। আবার অপরদিকে বিনিয়োগকারীকে লক্ষ্যপূরণের মত যথেষ্ট টাকা হচ্ছে না দেখে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। যেমন যেমন আয় বাড়বে বিনিয়োগও তেমন তেমন বাড়িয়ে যেতে হবে অর্থাৎ আজকের দিনের জন্য হতাশ হলে চলবে না, ফোকাস (Focus) থাকতে হবে, লক্ষ্যপূরণ না হলেও কাছাকাছি হয়তো চলে যেতেই পারেন। আমি অনেক ব্যক্তিকে এতবছরে দেখেছি যারা সব বুঝেও সঠিক সময়ে বিনিয়োগ শুরু না করার জন্য আফসোস করছেন এখন। এই সব ব্যক্তির নিজের রোজগার বৃদ্ধির ক্ষমতা সম্বন্ধে নিজেরই পরিষ্কার ধারণা ছিল না, যার ফলে আগে বিনিয়োগ শুরু না করার জন্য এখন আফসোস করছেন। বিপুল সংখ্যক লোক তাদের অর্থের সাথে লড়াই করে কারণ তারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী ঘটনাগুলির জন্য পরিকল্পনা করে না। গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী কাজগুলি বা লক্ষ্যগুলি ভাল পরিকল্পনা করে করলে জীবন আরও ভালভাবে অতিবাহিত করা যায়।
আর্থিক সমৃদ্ধি একটা প্রক্রিয়া (process), একটা পদ্ধতি (system), দীর্ঘদিন ধরে শৃঙ্খলা (discipline) মেনে ইনভেস্টমেন্ট করে গেলে সমৃদ্ধি আসবেই আসবে। রাতারাতি শেয়ার মার্কেট থেকে বড়লোক হওয়া যায় না ,যদি হয়েও যায় সেটা জুয়া, পরেরবার টাকা লাগালে তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
আমাদের এই পোস্টটি ভালো লেগেছে ? ভবিষ্যতের পোস্টগুলি মিস না করার জন্য অনুসরণ করুন
0 মন্তব্যসমূহ