আজকের দিনে শেয়ার মার্কেট যত সংখ্যায় মানুষ অবহিত তার থেকে অনেক কম সংখ্যার লোক বন্ড মার্কেট সম্পর্কে জানে। অথচ শেয়ার মার্কেট এর মতই বেশির ভাগ বন্ড কেনা বেচা করা যায়। আপনারা ভাবছেন বন্ড কি তাই তো সঠিক ভাবে জানি না, তার আবার কেনা বেচা । বন্ড হল ফিক্সড/স্থির ইনকাম/আয়ের অন্যতম ইন্সট্রুমেন্ট (Instrument)/মাধ্যম, যা একজন বিনিয়োগকারী কর্তৃক ঋণগ্রহীতার কাছে প্রেরিত ঋণকে বোঝায়। আপনার মনে হতেই পারে এর থেকে সহজ করে কি কিছু বলা যায় না? সাধারণত সরকার, কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং অন্যান্য সার্বভৌম সংস্থার যখন অর্থ সংগ্রহ করতে চায় তখন বন্ড বাজারে আনা হয় বা ইস্যু\জারি করা হয়। বিনিয়োগকারী মানে আপনি ইস্যুকারীকে একটি ঋণ দিচ্ছেন, এবং তারা আপনাকে একটি নির্দিষ্ট তারিখে ঋণের অভিহিত/ম্যাচুরিটি মূল্য ফেরত দিতে সম্মত হয় এবং আপনাকে বিভিন্ন পর্যায়ক্রমিক সুদের (সাধারণত বছরে দুবার) টাকা দেবার জন্য সম্মত হয়।
বন্ড বাজার বলতে বোঝায় সরকারী বন্ড, কর্পোরেট বন্ড এবং কর-মুক্ত বন্ডের মতো ঋণ সিকিউরিটিজ ব্যবসার বাজার। একটি বন্ড বাজার সাধারণত একটি ইকুইটি\শেয়ার বাজারের তুলনায় অনেক কম অস্থির হয়, যার ফলে যারা কম ঝুঁকি(Low Risk) নিতে চায় সেইসব বিনিয়োগকারীদের জন্য বন্ড উপযুক্ত। বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগের মাধমে আপনার পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠবে। একটি বন্ড মার্কেটের প্রাথমিক ভূমিকা হল সরকার এবং বড় বেসরকারী সংস্থাগুলিকে দীর্ঘমেয়াদী মূলধন যোগানে সহায়তা করা।
বন্ডের ধরন এবং ক্রেতার ধরণের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রকমের বন্ড বাজার রয়েছে। ক্রেতাদের ভিত্তিতে, দুটি ধরণের বন্ড বাজার রয়েছে - প্রাথমিক বাজার এবং সেকেন্ডারী বাজার। প্রাথমিক বাজার হল, যেখানে মূল বন্ড প্রদানকারী সরাসরি বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন ঋণ সিকিউরিটি বিক্রি করে। প্রাইমারি মার্কেটে কেনা বন্ড সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন করা যেতে পারে।
এবার কিছু জনপ্রিয় বন্ডের সাথে আপনাদের পরিচয় করাই:
কনভার্টেবল বন্ড: বিনিয়োগকারী/ক্রেতাকে এই বন্ডটি ইস্যুকারী কোম্পানির শেয়ারে রূপান্তর করার অধিকার বা বাধ্যবাধকতা দেয়। শেয়ারের পরিমাণ এবং শেয়ারের মূল্য সাধারণত ইস্যুকারী কোম্পানি দ্বারা পূর্বনির্ধারিত হয়। একজন বিনিয়োগকারী নির্দিষ্ট সময়ে বন্ডটিকে শেয়ারে\স্টকে রূপান্তর করতে পারেন। কনভার্টেবল বন্ড একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের হয় এবং বিনিয়োগকারীকে বন্ড কেনার সময় কতদিন অন্তর সুদের অর্থ দেওয়া হবে সেটি বলে দেওয়া থাকবে।
কনভার্টেবল বন্ডগুলিকে আরও তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:
• নিয়মিত বা রেগুলার কনভার্টেবল বন্ড - রেগুলার কনভার্টেবল বন্ড নির্দিষ্ট ম্যাচুরিটি তারিখ এবং পূর্বনির্ধারিত কনভার্টেবল মূল্যের সাথে বিনিয়োগকারীকে সুযোগ দেওয়া হয় (কোন বাধ্যবাধকতা নয়) কনভার্ট / পরিবর্তন করার জন্য। কোম্পানিগুলি সাধারণত জনসাধারণের কাছে এই ধরনের কনভার্টেবল বন্ড ইস্যু করতে বেশি পছন্দ করে।
• বাধ্যতামূলক কনভার্টেবল বন্ড - এই বন্ডগুলি বিনিয়োগকারীকে ম্যাচুরিটি পরে ইস্যুকারী কোম্পানির ইক্যুইটি শেয়ারে কনভার্ট / পরিবর্তন করতে বাধ্য করে৷ যেহেতু বিনিয়োগকারীরা মূলত তাদের বন্ডগুলিকে কনভার্ট / পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়, সেহেতু কোম্পানিগুলি সাধারণত বাধ্যতামূলক কনভার্টেবল বন্ডগুলিতে বেশি হারে সুদের অফার করে।
• বিপরীত (রিভার্স)কনভার্টেবল বন্ড - এই বন্ডে ইস্যুকারী কোম্পানি তাদের পূর্বনির্ধারিত কনভার্ট / পরিবর্তন মূল্যে ম্যাচুরিটির পরে, ইক্যুইটি শেয়ারে রূপান্তর করার অধিকার রাখে।
কনভার্টেবল বন্ডের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করে থাকে, যেমন ম্যাচুরিটির সময় পর্যন্ত তাদের বিনিয়োগের উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ পাওয়ার পাশাপাশি, শেয়ার / স্টক মূল্য বৃদ্ধির সুবিধাও উপভোগ করতে পারে। ইস্যুকারী কোম্পানির লিকুইডেশনের ক্ষেত্রে, বন্ডহোল্ডাররা কোম্পানির লিকুইডেশন আয়ের উপর প্রথম অগ্রাধিকারও পেতে থাকে।
ইস্যুকারী কোম্পানিও কনভার্টেবল বন্ড ইস্যু করে কিছু সুবিধা পায়, মূলধন বাড়াতে গিয়ে কোম্পানিকে অবিলম্বে তাদের শেয়ার লীকুইডিটি (অবিলম্বে নগদে পরিবর্তন ) করতে হয় না। যেহেতু বিনিয়োগকারী শেয়ার মূল্যের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে, তাই ইস্যুকারী সংস্থাগুলি সাধারণত প্রচলিত কর্পোরেট ঋণ সিকিউরিটিজের (Traditional Corporate Debt Securities) হারের তুলনায় কনভার্টেবল বন্ডে সামান্য কম সুদের হার অফার করে।
এবার আসি সরকারি বন্ডগুলোর কথায়, সরকারি বন্ডগুলি কেন্দ্রীয় এবং দেশের রাজ্য সরকারগুলি দ্বারা আনা হয়, পরিকাঠামো বিকাশের ক্ষেত্রে সরকারের (কেন্দ্রীয় ও রাজ্য) প্রচুর টাকার\তহবিলের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে নগদ অর্থের সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবার সহজ উপায় হল বন্ড ইস্যু করা। দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ অর্থাৎ 5 থেকে 40 বছর সময়ের জন্য এই বন্ড ইস্যু করা হয় সাধারনত।
সরকারি বন্ড ভারতীয় বন্ড বাজারের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। এই বন্ডগুলি সাধারণত ফিক্সড \ স্থিতিশীল রিটার্ন অফার করে এবং অত্যন্ত নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়। G-sec-এর সুদের হার সাধারনত 7% থেকে 10% এর মধ্যে থাকে। G-Secs কোম্পানি, বাণিজ্যিক ব্যাংক, সমবায় ব্যাঙ্কগুলি ছাড়াও বর্তমানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও ধীরে ধীরে খুবই পছন্দের হয়ে উঠছে।
সরকারি বন্ড অনেক ধরনের হয় :-
ফিক্সড-রেট বন্ড - নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই যে এই সরকারী বন্ডগুলিতে সুদের হার পুরো মেয়াদের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। এই ধরনের বন্ডের লক-ইন পিরিয়ড /ম্যাচুরিটি সাধারণত এক থেকে পাঁচ বছরের হয়। উদাহরণ স্বরূপ, 6.5% GOI 2020 বলতে ভারত সরকার ইস্যুকারী এবং মেয়াদপূর্তির বছর হল 2020 আর 6.5% ফেস ভ্যালু (face value) বা অভিহিত মূল্যের উপর প্রযোজ্য সুদের হার ৷ এখানে বলে রাখা ভালো, বছরের পর বছর মূদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে, বন্ডের মেয়াদ যত বেশি হবে, বন্ডের মূল্য হ্রাসের ঝুঁকি তত বেশি। বিনিয়োগকারী সময়ের আগে যদি বন্ডটি বিক্রি করতে চায় তাহলে জরিমানা হতে পারে ৷
ফ্লোটিং রেট বন্ড (FRBs) - এই বন্ডগুলির সুদের হার পরিবর্তনশীল, কতদিনের ব্যবধানে সুদের হারের পরিবর্তন হবে সেটা বন্ড জারি/ইস্যু করার আগে স্পষ্ট করা হয়। এই ধরনের বন্ড কেনার সবচয়ে ভালো সময় হল সুদের হার যখন কম থাকে এবং বাড়বে বলে আশা করা হয়। সুদের হারের পরিবর্তন বেঞ্চমার্ক হারের কার্যকারিতার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সমস্যা হচ্ছে যে,বেশ কিছু বাজার চলতি ভাষা আছে যেটার সঠিক বাংলা শব্দ নেই অথবা সেটা আরো কঠিন । এখানে বেঞ্চমার্ক বলতে বোঝায় জাতীয় সঞ্চয় শংসাপত্রের (NSC-ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট) সুদের হার। বন্ডের কুপন রেট (বন্ডের সুদের হার) প্রতি ছয় মাসে পুনরায় মেলানো হয় NSC-র সাথে। জানুয়ারি এবং জুলাই বছরে সাধারনত দুই বার সুদের হার নির্ণয় করা হয় আর এটাকেই রিসেট ফ্রিকোয়েন্সি বলে । NSC (ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট)এর থেকে 0.35% বেশি সুদ পাওয়া যায় এই বন্ডগুলিতে। এই যে NSCর নির্ধারিত সুদের উপরে আরো কিছুটা বেশি সুদ পাওয়া গেল এটাকে স্প্রেড বলে বিবেচনা করা হয়। ফ্লোটিং রেট বন্ডগুলি সুদের হারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করে কারণ উঁচু ফ্লোটিং রেট মানে উঁচু রিটার্ন।
ফ্লোটিং রেট বন্ডগুলিতে বিনিয়োগের আগে আপনারা কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয় বিবেচনা করে নেবেন, যেমন বেঞ্চমার্ক রেট,স্প্রেড,এবং রিসেট ফ্রিকোয়েন্সি।
সোভারিন গোল্ড বন্ড(SGBs)- গহনা সোনার পরিবর্তে SGB বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি জনপ্রিয় বিকল্প ইনভেস্টমেন্ট । সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এর তরফ থেকে এই বন্ড গুলো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া থেকে জারি/ইস্যু করা হয়। SGBs প্রতি বছর 2.50 শতাংশ (নির্দিষ্ট হার)রেটে সুদ প্রদান করে থাকে, এই সুদটা আবার করমুক্ত অর্থাৎ এর উপর কোনও ইনকাম ট্যাক্স ধার্য হবে না। বন্ডটি ইস্যু হবার তিনদিন আগে সোনার বিশুদ্ধতা স্তরের (purity level) 99% বাজারের গড় মূল্য (অ্যাভারেজ প্রাইস) থেকে এই বন্ডটির ক্রয়মুল্য নির্ধারন করা হয়। বন্ডটি এক গ্রামের স্বর্ণের মূল্য এবং তার গুনিতক হিসেবে ইস্যু/জারি করা হয়। অর্থাৎ SGBতে ন্যূনতম বিনিয়োগ হল এক গ্রাম সোনার দাম,আর সর্বাধিক সীমা একজনের জন্য 4 কেজি।
বিনিয়োগকারী স্বর্ণের পরিমাণ অনুযায়ী যে টাকাটা দেয় সেটা সুরক্ষিত, কারণ সে বর্তমান সময়ের বাজারের মূল্য পায়। বাজারে গহনা সোনা কিনতে গেলে আপনাকে গহনা তৈরি বাবদ খরচা বহন করতে হতো সেটা এক্ষেত্রে কিছুই নেই প্রায় । সুদের সময় স্বর্ণের বাজার মূল্য নিশ্চিত করা হয়, সাধারনত 5 বছর বা তার পরে বন্ডটি আবার নগদে রূপান্তর করা যায় , সেই সময়ের সোনার বাজার মূল্য অনুসারে বিনিয়োগকারী অর্থ ফেরত পান । এছাড়া আগেই বলেছি ,প্রতি বছর 2.50 শতাংশ (নির্দিষ্ট হার)রেটে সুদ পাওয়া যায়।
গহনা সোনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য চার্জ এবং বিশুদ্ধতা নিয়ে জালিয়াতি হবার যে সম্ভাবনা সেটা SGB হলে তার কোনও সম্ভাবনা নেই। বন্ডগুলি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক এর খাতায় বা Demat আকারে রাখা হয়, যাতে স্ক্রিপ্টের ক্ষতি হবার ঝুঁকি না থাকে। শুধুমাত্র স্বর্ণের বাজার মূল্য হ্রাস হলে মূলধন ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি-সূচক বন্ড - এই ধরনের বন্ডে অর্জিত মূল এবং সুদ মুদ্রাস্ফীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। সাধারণত, এই বন্ডগুলি খুচরা বিনিয়োগকারীদের জন্য জারি করা হয় এবং ভোক্তা মূল্য সূচক (বা CPI) বা পাইকারি মূল্য সূচক (বা WPI) অনুসারে সূচিত করা হয়।
এই ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটা কম জনপ্রিয় সরকারি বন্ড হয় যেমন 7.75% GOI সেভিংস বন্ড , কল বা পুট বিকল্পের সাথে বন্ড, জিরো-কুপন বন্ড, রাজ্য সরকারের মিউনিসিপ্যাল বন্ড ইত্যাদি।
এমন কিছু কোম্পানীর বন্ড আসে যেগুলো খুবই উঁচু রিটার্ন দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু রেটিং ভীষণ কম থাকে অর্থাৎ আপনার মূলধন সুরক্ষিত নয়। আবার তার মানে এই নয় সেগুলোতে কেউ অ্যাপ্লিকেশন করে না , অনেকেই উঁচু রিটার্নের আশাতে ঝুঁকি জেনেও বিনিয়োগ করে, যেমন -খুচরা বন্ড, জাঙ্ক বন্ড ইত্যাদি ।
আর এক ধরনের বন্ড হল রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনের আগে প্রচারের খরচার জন্য আনা বন্ড -নির্বাচনী বন্ড।
লেখাটা এর থেকে বড় হয়ে গেলে আর পড়বার ইচ্ছা আপনাদের থাকবে না তাই, এই সব বন্ডগুলো নিয়ে আবার একদিন আলোচনা করব।
আমাদের এই পোস্টটি ভালো লেগেছে ? ভবিষ্যতের পোস্টগুলি মিস না করার জন্য অনুসরণ করুন
0 মন্তব্যসমূহ